১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাস! লন্ডনের একটি মাঠে আহমেদ হোসাইন, রেজিনাল্ড এডকক সহ আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে জ্বলন্ত অঙ্গার। লাল টুকটুক করছে অঙ্গার গুলো। তারা ক্ষণিক সময়ের জন্য নিজেদের জীবনের শেষ সময়টা চোখ বন্ধ করে ফিল করছেন। গোল করে সবাই তাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। সবাই এই বুঝি তাদের জ্বলন্ত দেহ দেখতে পাবে। বারো ফুট লম্বা করে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৪০০ডিগ্রী ফারেনহাইটে জ্বলন্ত অঙ্গার। তার উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে তাদের। জীবনটা যেন ১২-ফুট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো। নাকি তার আগেই শেষ হয়ে যাবে? তাদের তো আর জ্যাক শোয়ার্জ এর মত সুপার ন্যাচারাল ক্ষমতা নেই, যে কি-না আগুণ নিয়ে খেলা করে। কি হবে?
Photo Credit:Dreamstime
চোখ বন্ধ করে হাঁটছে তারা। এক ফুট… দুই ফুট… তিন ফুট….. তারপর?
শেষ?
১২ ফুট! এই কি হলো!
‘আমরা কি আদৌ বেঁচে আছি? নাকি স্বপ্ন দেখছি? চারিদিকে সবার করতালি আর জমজমাট উত্তেজনা শোনা যাচ্ছে। আসলেই কি তাই? নিজেকে চিমটি কেটে বোঝা গেলো আসলেই।’
হুম তারা ১৪০০-ফারেনহাইট এর জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হেঁটে এসেছে। সামান্য ফোস্কা পড়া ছাড়া তাদের কিছুই হয়নি? কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি তারাও জ্যাক শোয়ার্জ এর মত সুপার ন্যাচারাল ক্ষমতার অধিকারী?
হ্যাঁ আসলেই সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার। কিন্তু এতদিন আমরা যা ভেবে এসেছি জ্যাক শোয়ার্জ এর নয় বরং সেই সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার আসলে ফিজিক্সের। চলুন আসলে এখানে হচ্ছেটা কি দেখে আসি।কোন ধরনের ক্ষত ছাড়া ১৪০০-ফারেনহাইটে জ্বলন্ত অঙ্গার এর উপর দিয়ে হেঁটে আসার ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় কাজ করে।
⚫যে অঙ্গার গুলো বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে যা যা থাকতে পারে তা হলো,কাঠ, কয়লা আর ছাই।
⚫এই জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাঁটার ক্ষেত্রে যে ভয়ানক জিনিসটা কাজ করে তা হলো তাপ। যার কারণে এর ওপর দিয়ে গেলে বুঝি অঙ্গারের সাথে মিশে যাবেন। তাই না?
কিন্তু কথা হচ্ছে সেই ভয়ানক শক্তিটা যদি আপনার কাঁছাকাঁছি না-ই আসতে পারে তাহলে কি হবে? কি ভাবছেন? আবোল-তাবোল বকছি? আপনি অঙ্গারের ওপর হেঁটে যাবেন, আর তার তাপ আপনাকে ছুঁবে না তা কিভাবে হয়! !তাই না? হুম আসলেই তাই। চলুন এবার ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা যাক।
আপনি অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাঁটছেন, আপনার কাছে অঙ্গার থেকে তাপ কত ভাবে আসতে পারে? হ্যাঁ, তিন ভাবে।
🔵পরিচলন।
🔵বিকিরণ।
🔵পরিবহন।
এবার দেখতে হবে এই তিন প্রক্রিয়া এখানে খাটছে কিনা।
Photo Credit:Dreamstime
◾আগে জেনে নেই পরিচলন সম্পর্কে। পরিচলন বলতে বুঝায়, বস্তু কণার স্থানান্তরের মাধ্যমে তাপ সঞ্চার। আর আমরা নিশ্চয় জানি শুধু মাত্র প্রবাহিত পদার্থ অর্থাৎ তরল ও গ্যাসীয় বস্তুর কণা-ই চলাচল করতে পারে। যখন কোনো উষ্ণ প্রবাহী পদার্থের অণু শীতল প্রবাহী পদার্থ সংস্পর্শে থাকেনা,তখন উভয়ের মধ্যে অণু চলাচলের মাধ্যমে তাপ সঞ্চারিত হয়। এটিই পরিচলন প্রক্রিয়া। কিন্তু ফায়ার ওয়াকিং এর ক্ষেত্রে কোনো প্রবাহী পদার্থ সরাসরি জড়িত নেই। যার কারণে বলতে পারি আপনি যদি অঙ্গারের উপর হেঁটেও যান তবে পরিচলন এর মাধ্যমে আপমার কাছে তাপ এসে আপনাকে পোড়ার সম্ভাবনা নেই।ওকে?
অনেক কেই দেখা যায় অজান্তে পা-কে ঠান্ডা রাখতে পা ভিজিয়ে নেন।যদি আপনি এটি করে থাকেন তাহলে ধরে নিন যে আপনি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছেন।কারণ পানি কিন্তু তাপ সুপরিবাহী যা অঙ্গারের তাপ আপনার পায়ের কাছে পৌঁছে দিবে গোয়েন্দার মতো।সুতরাং সাবধান!
Photo Credit:Dreamstime
◾এবার দেখা যাক বিকিরণ। এক্ষেত্রে তাপ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ আকারে পরিবাহিত হয়। যেমনটা আমরা সূর্য থেকে পেয়ে থাকি। সূর্য থেকে যে আলো আসে তার তাপ-ই আমরা পেয়ে থাকি। আর আমরা জানি, আলো এক-প্রকার ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ। অঙ্গার থেকে এই প্রক্রিয়ায় তাপ আসতে পারে। তবে আপনার জন্য আশার আলো হচ্ছে, এই প্রক্রিয়ায় খুব কম তাপ স্থানান্তরিত হয়। যা আপনাকে পুড়িয়ে মারার মতো ক্ষমতা রাখেনা।আর সবচেয়ে বড় কথা আপনি যখন অঙ্গারের ওপর হাঁটবেন, তখন নিশ্চয় কোমর দুলিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটবেন না। যদি আপনি আস্তে আস্তে হেঁটে থাকেন এর ফলে খুব বেশি তাপ রেডিয়েশন প্রক্রিয়ায় আপনার কাছে পৌঁছাতে পারে যা আপনার পোড়াতে সক্ষম হবে। সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হলে নিশ্চয় খুবই দ্রুত হাঁটবেন। আর এই অল্প সময়ে বিকিরণের মাধমে আপনার কাছে তাপ পৌঁছানো তেমন ইফেক্টিভ হবে না। আবার ফায়ার ওয়াকিং অঙ্গারের ওপর ছাই ব্যবহার করা হয়ে থাকলে তা বিকিরণ এ বাঁধা দেয়। সো চিল ব্রো!
Photo Credit:Dreamstime
◾এবার আসি লাস্ট ওয়ান, পরিবহণ।পরিবহণ বলতে বুঝায়, দুইটি পদার্থ সংস্পর্শে আসলে তাদের মধ্যে যেভাবে তাদের আদান প্রদান হবে তা। এক্ষেত্রে তাপ প্রাপ্ত হয়ে যখন পদার্থের কিছু কণা অনেক দ্রুত কম্পিত হবে সে তার পাশের কণাকে কম্পিত করবে। আবার পাশের কণা তার পাশের কণাকে এভাবে সমগ্র পদার্থের সকল কণা মোটামুটি তাপ পেয়ে কম্পিত হতে হতে তাপ পুরো পদার্থে ছড়িয়ে পড়বে। হ্যাঁ, অঙ্গারের উপর দিয়ে হাঁটার সময় আপনার পা নিশ্চয় কাঠ কয়লার সংস্পর্শে আসবে। আর অঙ্গারের তাপ আপনার শরীরে প্রবেশ করে আপনাকে পুড়ে ছারখার করে দিবে, তাই তো? না, এই জায়গায় আপনার জন্য সবচেয়ে বড় সুখবর হলো, কাঠ একটি তাপ অপরিবাহী পদার্থ, আর কয়লা? সে ত কাঠের চেয়ে চারগুণ অপরিবাহী।সেহেতু ভয়ের কিছু নেই। কাঠ কয়লার তাপ আপনাকে পুড়িয়ে মারতে পারবে না।
তো এসব শুনে আপনি কি মহা খুশি? আজকেই অঙ্গারের ওপর ঝাপ দিবেন ভাবছেন? তাহলে শুনেন, অঙ্গারের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলে আপনি হয়তো পুড়ে মরবেন না, কিন্তু কৌশলে না হাঁটলে নিশ্চয় আপনার পা এর মায়া ছাড়তে হবে।
এক্ষেত্রে আপনার কনফিডেন্স অটুট রাখা,হাঁটার সময় যেনো পা দিয়ে খুব প্রেশার দিয়ে না হাঁটা,দ্রুত এগিয়ে যাওয়া এসব সুন্দর করে মেইনটেইন করতে হবে।তাই তো এই ফায়ার ওয়াকিং করে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড এ নাম লিখায় একেক সময় একেকজন। সেহেতু ‘আমিও ফায়ার ওয়াকিং পারবো’ বলে ভাব নিয়ে লাভ নেই।
লেখকঃ মোহাম্মদ ফাহিম উদ্দীন
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ
References:
Responses