সৌরজগতের ৮টি গ্রহের মধ্যে শনির একটি বিশেষত্ব আছে, তাই না?
এটির বিশেষত্বের কারণ হলো এর বিস্ময়কর বলয়। বরফ এবং কসমিক আবর্জনার তৈরি হাজার মাইল জুড়ে প্রশস্ত ৭টি বলয় শনিকে আবৃত করে আছে। দিন – রাত যাই হোক সর্বদা এই অদ্ভুত বলয় চকচক করতে থাকে, যেনো এটি শনি গ্রহের বিশাল এক প্রতিরোধ্য বেষ্টনী। কখনো কি ভেবেছেন শনির কেন, পৃথিবীরও কি থাকতে পারতোনা এমন বলয়?
এমন যদি হতো, শনির মতোই পৃথিবী ও বলয়াবৃত হতো!
সৌরজগতে শুধু শনির নয় বরং ইউরেনাস, নেপচুনের ও এমন বলয় আছে। যেকোন গ্রহের ই তার অবস্থান অনুযায়ী বলয় থাকতে পারে। প্রত্যেক গ্রহেরই পৃষ্ঠ থেকে নির্দিষ্ট উচ্চতার “Roche Limit” নামক একটি দূরত্ব সীমা রয়েছে। এটি এমন এক দূরত্ব সীমা, যে দূরত্বে কোন বস্তু এসে পড়লে সেটি গ্রহের মহাকর্ষীয় টানে ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে যাবে এবং এর ধ্বংসাবশেষ সমূহ গ্রহের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে রিং তৈরি করবে। শনি, ইউরেনাস, নেপচুন গ্রহে ধুলোবালি, বরফ, শিলা এর পরিমাণ অত্যধিক। তাছাড়া এই গ্রহ সমূহের মহাকর্ষীয় টান এমন প্রবল যে তা বাইরের মহাকাশ থেকে যেকোন আবর্জনা টেনে নিতে পারে। এই ধ্বংসাবশেষ গুলোই গ্রহ সমূহের Roche limit-এ এসে রিং এ পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর রিং না থাকার পিছনে মূলত ৩টি কারণ বিদ্যমান-
- পৃথিবীর অত প্রবল মহাকর্ষীয় শক্তি নেই যে এটি বাইরের আবর্জনা টেনে নিবে।
- পৃথিবীর বায়ুমন্ডল তুলনামূলক পরিষ্কার, যা ধুলোবালি,বরফ,শিলা ইত্যাদিতে সয়লাব নয়।
- থাকলেও পৃথিবী সূর্যের এতটাই নিকটে যে, সূর্যের তাপ পানি, বরফ ইত্যাদিকে বায়ুবীয় পদার্থে পরিণত করে ফেলতে পারে।
তবে একটি উপায় আছে পৃথিবীর রিং তৈরি হওয়ার। সেটি হলো, যদি কখনো বাইরে থেকে কোন এস্টেরয়েড আমাদের বায়ুমন্ডলে ঢুকে পড়ে এবং পৃথিবীর Roche limit এ এসে যায় তাহলে তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পৃথিবীতে শিলার রিং তৈরি করতে পারে। আপনি জেনে অবাক হবেন,গবেষণা অনুসারে হয়তো এক সময় পৃথিবীর রিং ছিলো। প্রায় ৪.৫বিলিয়ন বছর আগে দুইটি প্রোটোপ্লানেট এর সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের জন্ম হয়। সেই প্রোটোপ্ল্যানেট এর একটি পৃথিবীতে পরিণত হয় এবং অপরটি নাম রাখা হয় Theia। সেই সংঘর্ষের যে ধ্বংসাবশেষ তা পৃথিবীর রিং তৈরি করে থাকতে পারে। যা বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের পরিক্রমায় বিলুপ্ত। আবার অদূর ভবিষ্যতে ও হয়তো চাঁদ এর কক্ষপথ ছোট হতে হতে এক সময় রচে লিমিটে এসে পড়বে ফলে চাঁদ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পৃথিবীর বলয়ে পরিণত হতে পারে।
কোথায় কেমন দেখতে হবে পৃথিবীর বলয়?
যেকোন গ্রহের বলয়ের জন্য সবচেয়ে স্থিতিশীল স্থান হলো এর বিষুবীয় অঞ্চল। আপনি যদি চলতে শুরু করেন, গ্রহের অক্ষাংশের পরিবর্তনের সাথে এই বলয়কে একেক জায়গায় একেক রকম দেখতে পাবেন।
যেমন আপনি যদি ইকুয়েডর এর রাজধানী কুইটো থেকে বলয়ের দিকে তাকান, তাহলে মনে হবে যেন একটি সরু রেখা দিগন্ত থেকে আকাশের উর্ধ্বে উঠে চলেছে।
যদি আর্কটিক সার্কেলে গিয়ে তাকান, মনে হবে এ যেনো দিগন্তের একটি খুঁটি।
আবার অধিকাংশ নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় মনে হবে, যেনো এক দৈত্যাকার খিলান আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হয়ে আছে।
এই চকমকে বলয় আমাদের সূর্যের মতো সকালে উদয় এবং রাতে অস্ত যাবেনা।
বরং দিন রাত যাই হোক না কেন একে সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন।
উজ্জ্বল বলয়
শনির বলয় বরফের তৈরি কিন্তু পৃথিবীতে যদি বলয় থাকতো তা কি শনির মতো বরফের তৈরি হতো?
পৃথিবী ও সূর্যের মর্ধ্যবর্তী দূরত্ব শনির চেয়ে অনেক কম।
তাই সূর্য থেকে যে তাপ পৃথিবী পেয়ে থাকে তা আমাদের বলয়ে বরফ থাকতে দিবেনা। যদি পৃথিবীর বলয় শিলার তৈরি হতো, তাহলে তা কেমন দেখাতো? চাঁদে যে শিলা গুলোর অস্তিত্ব রয়েছে তা চাঁদ যে আলো পেয়ে থাকে তার ১২% প্রতিফলন করে। এরা দেখতে ধূসর। কিন্তু চাঁদ আমাদের কাছাকাছি হওয়াই তাদের খুবই উজ্জ্বল দেখায়। আমাদের বলয় গুলো কেমন উজ্জ্বল হবে? প্রায় ১৩০০ ওয়াট আলো আমাদের বায়ুমন্ডলের প্রতি বর্গমিটারে আপতিত হয়। যদি আমাদের বলয় এর ১০% ও প্রতিফলন করে তাহলে এটির প্রতি বর্গমিটার এলাকা একেকটি ১৩০ ওয়াটের বাল্বের মতো উজ্জ্বল হবে। চাঁদকে যেমন আমরা রাতে জ্বলতে দেখি, তেমনি পৃথিবীর বলয় ও সূর্যের আলোর প্রতিফলনের কারণে রাতেও জ্বলজ্বল করতে দেখা যাবে।
পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে বলয়ের দূরত্ব
পৃথিবী যদি শনির মতো বলয়াবৃত হতো, তাহলে সেই বলয় পৃথিবী পৃষ্ঠের কত কাছাকাছি হতো?
University Corporation for Atmospheric Research অনুসারে শনির বলয়ের সাথে যদি তুলনা করেন, তাহলে দেখবেন আমাদের বলয় গুলো উচ্চতায় আমাদের বায়ুমন্ডলের থার্মোস্ফিয়ার নামক স্তর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে যা প্রায় ৬২০ মাইল বা ১০০০ কি.মি। তাই প্লেন উড়া নিয়ে চিন্তার কোন বিষয় নেই, কারণ আমাদের প্লেন সমূহ সাধারণত ৭মাইল উর্ধ্বে উড়ে থাকে।
এক নাকি একাধিক বলয়?
পৃথিবীতে একটি নাকি একাধিক বলয় থাকবে তা পৃথিবীতে শেফার্ড মুন থাকবে কি না তার উপর নির্ভর করবে। শেফার্ড মুন হলো এমন এক ধরনের উপগ্রহ, যা দুই বলয়ের মাঝে অবস্থান করে উভয় বলয়ের মাঝের স্থান পরিষ্কার করে এবং বলয়ের মাঝের পদার্থসমূহকে বাইরে যেতে বাধা দেয়। শেফার্ড মুন সমূহের মহাকর্ষীয় টানের কারণে বলয়ের মাঝের বিভিন্ন বস্তু তার দুপাশের রিং এ আটকে পড়ে। এটির আচরণ অনেকটা মেষ পালক যেমন তার ভেড়াকে বিপথগামী হতে না দেয় তেমন বলেই এই ধরনের উপগ্রহের নাম “Shepherd Moon”। শনির একাধিক শেফার্ড মুন আছে বলেই এতে একাধিক বলয় ও বিদ্যমান।
ছায়া
চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে স্থির নেই, অনবরত ঘুর্নায়মান । ঘুরতে ঘুরতে যখন চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী এক সরলরেখায় এসে যায় তখন চাঁদের উপর পৃথিবীর ছায়া পড়ে চাঁদ ঢেকে যায়। একে আমরা বলি চন্দ্রগ্রহণ। পৃথিবীর যদি বলয় থাকে তবে তা সর্বদা একজায়গায় স্থির থাকবে, তাই এটির উপর সর্বদা পৃথিবীর ছায়া পড়বে। আর সেই ছায়া হবে উপবৃত্তাকার। তবে দিনের সময়, ঋতু, অক্ষাংশে আপনার অবস্থান অনুযায়ী বলয়ের উপর পৃথিবীর ছায়ার তারতম্য ঘটবে।
বিষুবনের সময় অর্থাৎ যে সময় সূর্য নিরক্ষরবৃত্ত অতিক্রম করে এবং দিন-রাত সমান হয়, সে সময় সূর্য ও বলয় একই সমতলে চলে আসবে। সে সময় পৃথিবীর মধ্য অক্ষাংশে বলয়ের উপর পৃথিবীর ছায়া বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তীর্ন হবে। আর সে সময় একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। বিষুবীয় অঞ্চলে রিং এর এপাশ ওপাশ সূর্য দুভাগে ভাগ হয়ে যাবে। ফলে পৃথিবীর অর্ধেক আলো ও বাকি অর্ধেক ছায়ান্নিত হয়ে উঠবে।
পৃথিবীর ছায়া যেমন বলয়ে পড়বে একই ভাবে বলয়ের ছায়া ও পৃথিবীতে পড়বে। গ্রীষ্মের সময় উত্তর গোলার্ধে এবং শীতের সময় দক্ষিণ গোলার্ধে বলয়ের ছায়া পড়বে। ফলে শীতকালে পৃথিবী এখন যেমন শীতল থাকে তার চেয়েও বেশি শীতল হয়ে পড়বে। তাছাড়া বলয় যে আলোর প্রতিফলন ঘটাবে তা পৃথিবী এখন যে আলো গ্রহণ করে তার পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করবে। এর ফলে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন আরো প্রকট আকার ধারণ করবে।
বলয় ঘিরে যত বিশ্বাস
অন্যান্য প্রাণি থেকে মানুষ আলাদা হওয়ার একটা কারণ হতে পারে মানুষের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। কৌতুহলী মানুষ সবসময় ভাবতে থাকে, কিভাবে সে এসেছে এ ধরায়, কে পাঠিয়েছে তাকে। সর্বদা নানান কিছুতে তারা তাদের সৃষ্টি কর্তাকে খুঁজেছে। কেউ আগুনে, কেউ পাহাড়-পর্বতে, কেউ সূর্যে বা কেউ তারকারাজিদের মধ্যে তার সৃষ্টি কর্তাকে খুঁজেছে। পৃথিবী যদি বলয়ে আবৃত হতো, তাহলে হয়তো সেই বলয়টিও রেহায় পেতোনা।
যেহেতু এই বলয় সারাবছর, সারাক্ষণ একই অবস্থানে থাকবে, তাই তা এই গ্রহের মানুষের চিন্তা- চেতনায় অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। ঘিরে উঠবে নানান প্রচলন ও মিথ।
বিভিন্ন নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় যেহেতু বলয়টি দেখতে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ খিলানের মতো দেখায়, তা দেখে মানুষের মনে হতে পারে এ যেন স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে এক সংযোগকারী সেতু।
যেহেতু অক্ষাংশের পরিবর্তনের সাথে বলয়ের ও পরিবর্তন ঘটে তাই তার সাথে সাথে একে ঘিরে মানুষের চিন্তা ধারা ও পরিবর্তিত হতে পারে। আর এই চিন্তা ধারার ভিন্নতার কারণে মনুষ্যকূলে ঘটতে পারে সংঘাত, যেমনটা আমরা এখন দেখি বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতির পার্থক্য, বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে কত যুদ্ধ হাঙ্গামা ঘটে গিয়েছে এই ধরণী পৃষ্ঠে।
আবার এই বলয় মানুষকে পুরো বিশ্ব জুড়ে ঘুরে বেড়াতে প্রভাবিত করবে। বলয় কোথায় কেমন তা দেখে মানুষ তার কৌতুহল মিটাতে চেষ্টা করে যাবে। মানুষ হয়তো ছুটে চলবে বলয়টি কোথায় গিয়ে পৃথিবী পৃষ্ঠকে স্পর্শ করেছে তা দেখতে, যেমনটা আমরা রংধনুর এপার, ওপার দেখতে ছুটে বেড়াই।
স্যাটেলাইট নাকি বলয়?
সৌরজগতের সবুজ গ্রহটির সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণি মানুষ প্রকৃতিকে হাতের মুঠোয় এনেছে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বলয়াবৃত পৃথিবী কতটুক স্যাটেলাইট সমৃদ্ধ হতো? জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের কক্ষপথ ২২৩২৫ মাইল উর্ধ্বে যা বলয়ের চেয়ে যথেষ্ট উর্ধ্বে। কিন্তু পৃথিবীর বলয় থাকলে তা স্যাটেলাইটের রেডিও সিগন্যালকে ব্যবহার করতে পারে, সেক্ষেত্রে এটি স্যাটেলাইটের কার্যক্ষমতায় খারাপ প্রভাব ফেলবে।
আবার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ২৫০ মাইল উর্ধ্বে যা আমাদের কাল্পনিক বলয়ের যথেষ্ট নীচে অবস্থান করবে।
আকাশের হাজারো তারকার খেলা দেখে মানুষ সব সময় অভিভূত হয়েছে। তারাদের গতিবিধি দেখে কত ভবিষ্যত বাণী করেছে প্রাচীন জ্যোতিষীরা। এই বিশাল আকাশকে ঘিরেই তৈরি হয়ে গিয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান নামক বিজ্ঞানের একটি বড় শাখা। কিন্তু পৃথিবী যদি শনির বলয়ে পড়ে,তা নিশ্চয়ই মানুষের আকাশ দর্শনে বাঁধা তৈরি করবে। এর প্রভাব থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও মুক্তি পেতোনা। ফলস্বরূপ হয়তো আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরেকটু পিছিয়ে যেতাম!
Responses