অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিক : কেনো আমরা আবেগের দাস

মৃন্ময়ী দুর্দান্ত অভিনয় করে। ক্যাম্পাসে বেশ কিছু মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে বেশ খ্যাতি কুড়িয়েছে। একদিন নামী থিয়েটর সংস্থা থেকে তাদের একটি নাটক প্রচারের জন্য অডিশনে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যেহেতু অভিনয়ের প্রতি মৃন্ময়ীর সর্বদা একটা গভীর রকমের আসক্তি ছিল তাই এটা ছিল তার জন্য অনেক বড় একটা সুযোগ। তো যেদিন সে আমন্ত্রণ পেলো সেদিন তার সেমিস্টারের গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষার ফলাফল ছিল। দুর্ভাগ্যবশত মৃন্ময়ী ঐ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয় যা স্বাভাবিকভাবেই তাকে মর্মাহত করে। এটা কেবল তাকে ক্ষুব্ধ ও বিচলিত করেনি, তার আত্মসম্মানে আঘাত হানে। ফলস্বরূপ সে প্ররোচিতভাবে থিয়েটর সংস্থাকে জানিয়ে দেয় সে নাটকটির অডিশনে অংশ নিতে আগ্রহী নয়।

পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় মৃন্ময়ীর নেতিবাচক আবেগ নাটকটির অডিশনে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে ভাবছিল এই অডিশনেও তার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এটা নিঃসন্দেহে অযৌক্তিক। কারণ পরীক্ষায় মৃন্ময়ীর পারফরম্যান্স আর তার অভিনয় দক্ষতা সম্পূর্ণ সতন্ত্র। ফলস্বরূপ সে একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হলো। আর এই দৃশ্যটি মূলত অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিক নামে পরিচিত।

Image source:ScienceDirect.com

অর্থ্যাৎ অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিক হলো এমন একটা মানসিক অনুসন্ধিৎসু ব্যাপার যেটা ব্যাখ্যা করে কোন কারণে মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তার ঐ মুহূর্তের আবেগ দ্বারা প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত হয়। অর্থ্যাৎ কেনো আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যুক্তির পরিবর্তে আমাদের আবেগের উপর নির্ভর করি।

এটা অবাক করার মতো ব্যাপার না যে, আমরা ছোট-বড় যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আবেগের দ্বারা প্রভাবিত হই। এটা সকলে জানি যে যখন আমরা খুশি থাকি তখন কোনো কিছুতে ঝুঁকি নেওয়া বা নতুন কিছু চেষ্টা করার সম্ভাবনা বেশি থাকে যেখানে সামান্য বিষাদগ্রস্ত হলেই পা গুটিয়ে বসে থাকি। কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যদি আপনার মধ্যে “গাট ফিলিং” কাজ করে তখন বুঝতে হবে আপনি অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিকের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছেন।

ব্যাপারটি কেনো ঘটে?

ডুয়াল প্রসেস থিওরি অনুযায়ী, আমাদের মধ্যে দু’ধরনের কগনিটিভ সিস্টেম বিরাজমান। একটা হলো স্বয়ংক্রিয় অন্যটা হলো প্রচেষ্টাযোগ্য। এই অনুযায়ী অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিক ঘটে স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমটির জন্য। আমাদের মেজাজ কোনো নির্দিষ্ট কিছুর ঝুঁকি এবং সুবিধা সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে পরিবর্তন করে। যেমন ধরুন আপনি কোনো একটা কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠিত একটা ইভেন্টে বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। পরবর্তীতে যখন একই কনভেনশন সেন্টারে অন্য কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হবেন তখন আপনি পূর্বেকার ঘটনা স্মরণ করে খানিকটা রাগান্বিত হবেন। ফলে ইভেন্টটি আপনার জন্য যতই সহায়ক হোক আপনি ওখানে উপস্থিত হতে দ্বিধাবোধ করবেন যদিও ইভেন্ট ও সেন্টার আলাদা দুটি বিষয়। অর্থ্যাৎ আমরা ব্যাপারগুলোকে যুক্তি দিয়ে বিবেচনা না করে আবেগকে প্রাধান্য দিই।

” রাগের মাথায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ” অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিকের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ডুয়েল সিস্টেম থিওরি কি?

ডুয়াল সিস্টেম থিওরি হলো কগনিটিভ সাইকোলজির একটা ফাউন্ডেশনাল তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের দুটি স্বতন্ত্র কগনিটিভ (জ্ঞানীয়) সিস্টেম রয়েছে। সিস্টেম-১ হলো দ্রুত, অনায়াস, স্বয়ংক্রিয় এবং সংবেদনশীল প্রক্রিয়া আর সিস্টেম-২ খুবই ধীর তবে উদ্যমী, ইচ্ছাকৃত ও যৌক্তিক প্রক্রিয়া। অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিক মূলত সিস্টেম-১ এর কারণে হয়ে থাকে।

অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিকের ভালো-মন্দ দিক

একটি প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে যে, ডুয়েল সিস্টেম থিওরির সিস্টেম-১ যেহেতু আবেগের ভিত্তিতে এবং যুক্তি দ্বারা নয় সেহেতু এই প্রক্রিয়া ত্রুটিযুক্ত এবং সর্বদা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে আমাদের পরিচালিত করে অন্যদিকে সিস্টেম-২ গোড়ার দিক থেকেই যুক্তিযুক্ত তাই এটা প্রতিটি দিক থেকেই শ্রেয়। যাই হোক ড্যানিয়েল ক্যাহ্নেম্যান তার “থিংকিং ফাস্ট এন্ড স্লো” বইয়ে যেমনটি উল্লেখ করেছেন “Both systems have their pros and cons”। তাই বলা যায় সিস্টেম-১ তথা অ্যাফেক্ট হিউরিস্টিকেরও কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। সিস্টেম-১ তখনই হিতকর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় খুব অল্প সময় থাকে। এছাড়া এর মাধ্যমে কোনো কিছুর ব্যাপারে আমাদের উপলব্ধি কি তা জানতে পারি।

তবে এর নেতিবাচক দিকগুলো হলো, আবেগের বশবর্তী হয়ে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে সব অপশন নীরিক্ষা করা হয় না ফলে কিছু সুবিধা হাতছাড়া হয়ে যায়।

যায় হোক, যখন আপনি কোনো বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুখোমুখি হবেন তখন সিস্টেম-১ এর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করলে চলবে না, সময় নিয়ে যুক্তিপূর্ণভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে মেন্টাল শর্টকাটের পরিবর্তে সবগুলো অপশনই বিবেচনা করা দরকার।

এটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। গবেষণা বলছে অন্তঃব্যাক্তিক যোগাযোগ (নিজের সাথে নিজের যোগাযোগ) আত্মনিয়ন্ত্রনের একটি ফলপ্রসু উপায়। আবেগী হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কয়েক মুহূর্ত নিজের সাথে নিজের কথা বলা উচিত। এটা নিজেকে অবিচল, সহনশীল সর্বোপরী লেভেল-হেডেড থাকতে সাহায্য করবে। এমন একটা উত্তেজক মুহুর্তে এই প্রক্রিয়া আপনাকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত রাখবে।

Reference:

[1] The Art of Thinking Clearly- Rolf Dobelli

[2] https://thedecisionlab.com/biases/affect-heuristic/

লেখক : তাসরিম ছাবেরী

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

Share:

Facebook
LinkedIn
WhatsApp

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

On Key

Related Posts

Writing Research Paper With Latex

Why to use LaTeX?

Making the one around you use LaTex or convince a colleague to move where you can write up your whole document in word is a

Total Differentiation explained in bangla.

TOTAL DIFFERENTIATION শব্দটি প্রথম শোনার পর মনে হতে পারে অনেক জটিল কিছু।আজকে আমরা বিষয়টিকে খুবি সহজভাবে বুঝার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।Total Differentiation কে আমরা দুইভাগে আলোচনা

মার্কেটিং এর শুরুতে ‘ঠিক বেঠিক মার্কেটিং’

বইঃ ঠিক বেঠিক মার্কেটিং লেখকঃ গালিব বিন মোহাম্মদ  প্রকাশনীঃ আদর্শ রেটিংঃ৮/১০ আপনিও যদি মার্কেটিং জগতে নতুন প্রবেশ করতে চান তাহলে “ঠিক বেঠিক মার্কেটিং” বইটি আপনার