বিজ্ঞান কল্পকাহিনি যারা পছন্দ করেন অথবা এ বিষয়ক গল্প পড়েছেন বা মুভি দেখেছেন তারা নিশ্চয় সবুজ ত্বক বিশিষ্ট মানুষের বিভিন্ন কারিশমা দেখে অভিভূত হয়েছেন! ‘Little Green Man’, ‘Star Wars Rebels’ এর ‘Hera Syndulla’, ‘Guardian Of Galaxy’ ইত্যাদি মুভি নিশ্চয় আপনার লোম খাড়া করেছে, তাই না? কিন্তু কি হতো যদি তা শুধু কল্পকাহিনীতেই সীমাবদ্ধ না থাকতো? কি হতো যদি মানুষের সত্যিই সবুজ ত্বক থাকতো আর সালোকসংশ্লেষণ করার সক্ষমতা থাকতো?
মানুষের না থাকলেও এমন অনেক প্রাণি আছে যাদের এই সালোকসংশ্লেষণ এর সক্ষমতা রয়েছে। চলুম প্রথেমেই জেনে নিই সেই সকল বিস্ময়কর প্রাণির কারিশমা সম্পর্কে।
প্রত্যেক প্রাণিই বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য গ্রহণ করে। কিন্তু উদ্ভীদ তার বেঁচে থাকার শক্তি উৎপাদন এর জন্য সালোকসংশ্লেষণ এর উপর নির্ভর করে। তবে এমন অনেক প্রাণি রয়েছে যারা সূর্যের আলোকে বিভিন্ন বিস্ময়কর কাজে ব্যবহার করে থাকে।
Pea Aphid নামক পতঙ্গ এক ধরনের পিগমেন্ট তৈরি করে যা সূর্যের আলোর মাধ্যমে ATP (Adenosine Triphosphate) তৈরি করে। যা কোষের বিভিন্ন বিক্রিয়া সম্পাদনের জন্য শক্তি সরবরাহ করে।
Image : Pea Aphid
Source:Invasive.org
Oriental Hornet নামক পতঙ্গের বাইরের ত্বকের প্রান্তের দিকে হলুদ পিগমেন্ট বিদ্যমান যা সূর্যের আলো গ্রহণ করে। সেই শক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রুপান্তর করার মাধ্যমে সে তার গর্ত তৈরির শক্তির যোগান পেয়ে থাকে।
Image: Oriental Hornet
আবার কিছু প্রাণি এই সৌর শক্তিকে সরাসরি সালোকসংশ্লেষণ এর জন্যই ব্যবহার করে। উদ্ভিদ সাধারণত তার ক্লোরোপ্লাস্টের মাধ্যমেই নানান বিক্রিয়া ঘটিয়ে সালোকসংশ্লেষণ সম্পন্ন করে। কিন্তু প্রাণির ক্লোরোপ্লাস্ট নেই। তাহলে তারা কিভাবে এই কাজটি করে? হ্যাঁ, Elysia Sea Slug নামক সামুদ্রিক প্রাণির এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে। তারা যে সকল সামুদ্রিক শৈবাল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদের থেকে ক্লোরোপ্লাস্ট চুরি করে এবং সেই চুরি করা ক্লোরোপ্লাস্ট এর মাধ্যমে সে উদ্ভিদের মতোই সালোকসংশ্লেষণ সম্পন্ন করতে পারে।
image:Elysia Sea Slug
Source:NSF
আবার অনেক প্রাণি আছে যারা বিভিন্ন উদ্ভিদ জাতীয় জীবের সাথে মিউচুয়াল পার্টনারশিপ সম্পর্ক তৈরি করে (মিউচুয়াল পার্টনারশিপ হলো যখন দুইটি ভিন্ন জীব একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে বসবাস করে। এক্ষেত্রে উভয় জীব-ই একে অপরের মাধ্যমে উপকৃত হয়) এক্ষেত্রে তাদের নিজেদের দেহের মধ্যেই সালোকসংশ্লেষণ ঘটে তবে তা তার দেহের সেই উদ্ভিদ জাতীয় জীবটিই সম্পন্ন করে। যেমন বিভিন্ন সামুদ্রিক Corals ফটোসিমবায়োটিক অণুজীব Xoozanthallae এর সাথে আবার স্পটেড স্যালাম্যান্ডার শৈবালের সাথে মিউচুয়াল পার্টনারশিপ সম্পর্ক তৈরি করে এবং একে অপরের মাধ্যমে উপকৃত হয়।
বুঝা গেলো এরকম অনেক প্রাণি আছে যারা সরাসরি সালোকসংশ্লেষণ এর মাধ্যমে উপকৃত হয়। কিন্তু মানুষ কি তা পারবে? এমনকি যদি মানুষের নিজের সালোকসংশ্লেষণ করার সক্ষমতা থাকে তাহলে তারা এর মাধ্যমে কতটুকু উপকৃত হতো?
ইংল্যান্ড এর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্ল্যান্ট ইকোলজিস্ট Lindsay Turnbull এর মতে- “যদি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার ত্বক উদ্ভিদের পাতার মতো ফটোসিনথেটিক হতো তাহলে সে তার ত্বকের সালোকসংশ্লেষণ এর যে শক্তি পেতো তার মাধ্যমে তার মোট শক্তিচাহিদার মাত্র ১% মেটাতে পারতো। আপনি জেনে অবাক হবেন ঐ মহিলার শক্তির চাহিদা মেটাতে তার যে ত্বক রয়েছে তা যথেষ্ট নয় এর জন্য তার টেনিস কোর্ট এর মতো বিশাল ত্বক প্রয়োজন হবে।”
তাছাড়া সালোকসংশ্লেষণ এর জন্য প্রয়োজন কার্বন ডাই অক্সাইড। উদ্ভিদ এর পাতায় স্টোমাটা নামক ছিদ্র বিদ্যমান থাকে, যার মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড তার কোষে পৌঁছায়। ঠিক ফটোসিন্থেটিক মানুষের জন্য প্রয়োজন এরকম ছিদ্রযুক্ত ত্বক। কিন্তু এমন ছিদ্রযুক্ত ত্বক এর মাধ্যমে মানুষের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উপাদান বেরিয়ে আসতো বা বাইরে থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান তার শরীরে ঢুকে যেত। যা মানুষের জন্য খুবি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে।
তবুও এই সালোকসংশ্লেষণ মানুষের জন্য অল্প হলেও উপকারে আসবে। John Schalzi এর ‘Old Mans War’ উপন্যাস যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয় দেখেছেন সেখানকার সৈনিকরা বিভিন্ন বিস্ময়কর ক্ষমতার সাথে সাথে তাদেরকে ইঞ্জিনিয়ার্ড সবুজ ত্বক ও ছিলো।
সেখানে সেই সৈনিকরা তাদের সকল শক্তি সালোকসংশ্লেষণ থেকে পেতোনা, তবে তারা এই সালোকসংশ্লেষণ থেকে অতিরিক্ত শক্তি পায় এবং তাদের শরীর অক্সিজেন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড উভয়টিই ব্যবহারে সক্ষম ছিলো। যার কারণে তারা নিজেদের যেকোন পরিবেশের সাথেই খাপ খাওয়াতে পারে, এবং এর ফলে তারা তাদের কার্যক্রম বিনা ক্লান্তিতে দীর্ঘ সময় ধরে সম্পন্ন করতে পারে। মানুষ যদি সত্যিই ফটোসিন্থেটিক হতো তাহলে তাদের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটতো।
আচ্ছা আরেকটি প্রশ্ন সালোকসংশ্লেষণ এর সময় আপনার কেমন অনুভব হবে?
John Schalzi জানিয়েছেন-“এটি আপনাকে সব সময় কফি পান করার মতো অনুভূতি প্রদান করবে। আপনি এখন হয়তো ঘুম থেকে উঠে বলেন ‘আমাকে কফি দাও’, কিন্তু তখন হয়তো বলবেন ‘আমাকে আলো দাও’।”
এবার আসুন একটু ভাবি,যদি মানুষ সত্যিই সালোকসংশ্লেষণ এ সক্ষম হতো তাহলে আমাদের ইতিহাস কেমন হতো?
John Schalzi’-র মতে- “এতে মানুষ মানুষ-ই থাকবে। কোন সুপার পাওয়ার পেয়ে যাবে না। কারণ এর মাধ্যমে যে অতিরিক্ত শক্তি আপনি পাবেন তা কিন্তু আপনার শরীরে বিদ্যমান সেই ভয়ানক ক্ষুধার্ত অঙ্গের মধ্যেই খরচ হয়ে যাবে। সেই অঙ্গটি হলো আপনার মস্তিষ্ক। তবে একটি কথা যেহেতু আপনার মস্তিষ্ক কাজ করার জন্য আরো বেশি শক্তি পাচ্ছে এর জন্য মস্তিষ্কের কার্যকলাপ আরো দ্রুততর হতে পারে আর এর ফলে হয়তো আজকের যে আধুনিক বিশ্ব তা আমরা আরো ১০০০ বছর আগে পেতাম। মানবসভ্যতা আরো ১০০০বছর এগিয়ে থাকতো।”
আরেকটি বিষয় আপনাকে অবাক করবে। তা হলো মানুষ পরিবেশের আরো বেশি উপাদানের সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারবে যা হয়তো এখন পারছে না। যেমন মরুভূমির সেই উষ্ণ অঞ্চল হয়তো আরো মানুষের শ্রুতিতে মুখর থাকতো। এখন যেখানে বসবাস খুবি কঠিন। মানুষ ফটোসিন্থেটিক হলে তখন তারা মরুভূমির রৌদ্রস্নাত আলো নিজের শরীরে ধারণ করতে পারতো। অসাধারণ না?
তবে একটা বিষয় বিঘ্নিত হতো নিশ্চয়। মনুষ্য জাতি অন্যান্য প্রাণি থেকে বিশেষত্ব অর্জন করেছে তাদের লজ্জা আর সেই লজ্জা নিবারণ এর জন্য ব্যবহৃত কাপড়। কিন্তু মানুষ যদি সালোকসংশ্লেষণ এর জন্য আলো গ্রহণে সক্ষম হতো। তাহলে তা গ্রহণ করার জন্য তাদের নিশ্চয় পোশাকহীন থাকতে হবে অথবা পোষাক হয়তো স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রতীক হতো। হয়তো আপনি আপনার প্রয়োজনীয় আলো গ্রহণ করার পর বলতেন, ‘আমার যথেষ্ট আলো নেওয়া শেষ এবার আমি পোশাক পড়বো’ হা হা হা।
তবে যাইহোক মহাবিশ্ব যেভাবে চলছে তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তনে মহাবিশ্ব অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। তাই সৃষ্টিকর্তা আমাদের এভাবেই অভিযোজন করিয়েছেন। এভাবেই আমাদের বিশেষত্ব।
রেফারেন্স
Responses