খুব অবাক হলেন তাই না? ভাবছেন পাগল হয়ে গেলাম নাতো?? ঠিক এমন একটি ঘটনা ঘটেছিলো “আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স (AAAS)-এর ১৩৯ তম অধিবেশনে। বিখ্যাত গণিতবিদ এবং আবহাওয়াবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জ একটি বিশেষ প্রশ্নের উত্থাপন করেছিলেন যা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক হয়েছিলেন। প্রশ্নটি ছিলো এমন যে,
“ব্রাজিলে যদি কোনো একটি প্রজাপতি তার ডানা ঝাপটায়, তবে সেই ডানা ঝাপটানোর সুবাদে টেক্সাসে টর্নেডো হতে পারে কি-না?” লরেঞ্জের এই প্রশ্ন শুনে অনেকেই ভাবতে পারে হয়তো তিনি ঠাট্টা করছেন তার সাথে সাথে কিছু প্রশ্নেরও উদয় হতে পারে, তাই না?
• প্রজাপতি কি করে টর্নেডোর কারন হবে?
• আবার যদি টর্নেডো হয়েই থাকে তাহলে জায়গাটা নির্দিষ্ট করা কেন?
• টর্নেডো না হয়ে অন্য কোনো দূর্যোগ কেন হবে না?
লরেঞ্জের এই তথ্য (information) পরবর্তিকালে পরিচিতি পায় “বাটারফ্লাই ইফেক্ট (butterfly effect) ” নামে।
বাটারফ্লাই ইফেক্টের উৎপত্তি (Derivation) :-
এর্ডওয়ার্ড লরেঞ্জ বলেন, “সাধারণত ধারণা করা হয় যে, যেসব ঘটনা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে, সেসব এর মধ্যে আছে পারমাণবিক বোমা, উন্মাদ রাজনীতি, বড়-সড় ভূমিকম্প অথবা কোনো গণআন্দোলন। কিন্তু আধুনিক চিন্তা-ধারার কারণে মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, এসব আসলে তাদের ভুল ধারণা। Chaos Theory বা বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস বা ঘটনার পরিবর্তন সমগ্র পৃথিবীর পরিবর্তন করতে পারে। একটি প্রজাপতি যখন আমাজন জঙ্গলে ডানা ঝাপটায়, তখন এর ফলে বাকি অর্ধেক ইউরোপে তখন ঝড় হতে পারে।”
‘গুড ওমেনস’ (good omens)
লরেঞ্জের বিষয়বস্তু ছিলো আবহাওয়া ও গনিত। ১৯৫০ সালে এমআইটি (MIT)-তে অধ্যয়নকালে তিনি এই দুই বিষয় নিয়ে গবেষনা করে আবহাওয়া সম্পর্কিত একটি মডেল পেয়েছিলেন যা ছিলো পূর্বেরটি থেকে অনেকাংশে ভিন্ন। এই মডেলের মাধ্যমে আবহাওয়া পূর্বাভাস পাওয়া যেত। পরবর্তিকালে এটি নিয়ে আরো অনুসন্ধান করতে গিয়ে “বাটারফ্লাই ইফেক্ট”-এর উৎপত্তি হয়। এটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও এডওয়ার্ড লরেঞ্জকে “বাটারফ্লাই ইফেক্টের জনক” বলা হয়।
বিশৃঙ্খলা তও্ব(Chaos theory) :-
বর্তমান যখন কোনো ভবিষ্যৎ নির্ধারন করে অর্থাৎ বর্তমানে করা কোনো কাজ উপর নির্ভর করে ভবিষ্যতে কি ঘটবে এটাকেই বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব বলে। মূলত যেসব ঘটনা আপাত দৃষ্টিতে বর্ননা করা সম্ভব না সেগুলো সর্ম্পকে ধারনা দেয় বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব। যেমন শেয়ার মার্কেটিং, তরল প্রবাহ, হার্টবিট অনিয়ম, আবহাওয়া এবং জলবায়ু সহ অনেক প্রাকৃতিক সিস্টেম।
লরেঞ্জের আবহাওয়া তও্ব(Weather theory) :-
লরেঞ্জ আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার জন্য প্রাথমিক শর্ত হিসেবে ০.৫০৬ একটি গাণিতিক মান ব্যবহার করেন। এই মান আসলে আরো একটু বিস্তৃত ছিলো, অর্থাৎ দশমিকের পর আরো অঙ্ক ছিলো। এর আসল মান ছিলো ০.৫০৬১২৭। তিনি যখন দশমিকের পরে ছয় অঙ্ক নিয়ে গণনা শুরু করলেন, তখন একটি মান আসলো যা তিন অঙ্ক নিয়ে গণনা করা ফলাফলের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন ছিলো। অথচ শুধু দশমিকের পরে মাত্র তিনটি অঙ্কই বাদ দেয়া হয়েছিলো, যার ফলাফলে দেখা গেলো আমূল পরির্বতন।
এর থেকে তিনি কম্পিউটার প্রোগ্রামে প্রায় ১২টি মান প্রদান করেন (যা মূলত তাপমাত্রা, বাতাসের গতি, আর্দ্রতা) ইত্যাদির। এর থেকেই তিনি বুঝতে পারেন কোনো সিস্টেমে ক্ষুদ্র ত্রুটির কারনে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। “প্রজাপতি প্রভাব” দ্বারা লরেঞ্জ এটা বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, কোনো তত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি খুব সাধারন ঘটনা বড় কোনো মানের পার্থক্য সৃষ্টি করে দিতে পারে।
বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন এই বাটারফ্লাই ইফেক্টকে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে, “একটি পেরেকের অভাবে জুতা ব্যবহার হলো না, জুতার অভাবে ঘোড়াও চলতে পারলো না, ঘোড়ার অভাবে ঘোড়ার সহিসও থাকলো না, ঘোড়ার সহিসের অভাবে যুদ্ধে জেতা গেলো না, যুদ্ধে হারার কারণে রাজত্ব হারিয়ে গেলো, শুধুমাত্র ঘোড়ার জুতার একটি পেরেকের অভাবেই এতকিছু হলো”
“প্রজাপতি ইফেক্ট”-এর সাথে সম্পর্কিত কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা :-
নাগাসাকির বোমা হামলা:-
আমেরিকা সর্বপ্রথম জাপানের কুরোকোতে অবস্থিত একটি গোলা-বারুদ কারখানাতে বোমা ফেলার পরিকল্পনা করে। কিন্তু হামলার দিন মেঘাচ্ছন্নতার কারনে কারখানার উপর দিয়ে বিমান চলাচলে বাধাগ্রস্থ হয়। পাইলট পরপর তিনবার কুরোকোর উপর বিমান চালিয়ে ব্যর্থ হয়। যার ফলে নাগাসাকি শহরে আক্রমন করা হয়। সেদিন যদি আকাশে মেঘ না থাকতো তাহলে ইতিহাস ভিন্ন হত। এজন্য কুরোকোকে জাপানের ভাগ্যবান শহরও বলা হয়।
ভিয়েনার একাডেমি অফ ফাইন আর্টস কর্তৃক অ্যাডল্ফ হিটলারের আবেদন প্রত্যাখ্যান :-
১৯০০ সালের গোড়ার দিকে অল্প বয়স্ক হিটলার একটি ভিয়েনার একটি আর্ট স্কুলে আবেদন করে। একজন ইহুদি অধ্যাপক তার আবেদন পরপর দু’বার প্রত্যাখ্যান করে। এটি হিটলারের মনের উপর একটি বিরোপ প্রভাব ফেলে। যার ফলে সে পরবর্তিতে ইহুদিদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সে যদি নিজেকে শিল্পী হিসেবে ব্যস্ত রাখতো তাহলে হয়তো এই ট্রাজেডি এড়ানো যেত।
আর্কডুক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ হত্যার ঘটনা:-
১৯১৪-এর ২৮শে জুন, গাভ্রিলো প্রিন্সিপাল নামে এক কিশোর বসনিয়ান-সার্ব অন্য দুই জাতীয়তাবাদীর সাথে সরজেভোতে গিয়েছিলেন আর্কডুককে হত্যা করতে। গাড়ির নিচে বোমা বিস্ফোরিত হয় ফলে তার ড্রাইভার আহত হয়। হামলাকারীরা রাস্তা পরিবর্তন করে যা ড্রাইভার খবর পাইনি। ফলে তারা একই রাস্তায় যায় এবং আর্কডুক ও তার স্ত্রীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
কিউবার মিসাইল সঙ্কট :-
কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের সময় আরকিপোভ কিউবার কাছে পারমাণবিক-সজ্জিত সাবমেরিনে অবস্থান করছিলেন। সাবমেরিনে সংকেতগুলো গভীরে নিমজ্জিত থাকায় উপরের বিশ্বে কি হচ্ছে সে সম্পর্কে ধারনা ছিল না। ফলে অধিনায়ক সাভিটস্কি এই সংকেতকে যুদ্ধ শুরুর ইঙ্গিত হিসেবে ধরে টর্পেডো চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। টর্পেডো চালু হলে পারমাণবিক বোমা মস্কো, লন্ডন, পূর্ব অ্যাঙ্গেলিয়া এবং জার্মানিতে আঘাত হানত, ব্রিটিশ জনসংখ্যার অর্ধেককে নিশ্চিহ্ন করে দিত। ফলে দেশগুলোর পাল্টা সংঘাতের কারনে বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক হলোকাস্ট হতে পারত। কিন্তু সেক্ষেত্রে আরকিপোভ অধিনায়কের সিদ্ধান্তে ভেটো প্রদান করে ফলে বিশ্ব রক্ষা পায়। এজন্য ভ্যাসিলি আরকিপোভকে ” বিশ্বকে বাচাঁনো মানুষ ” বলা হয়।
Reference :-
• https://en.m.wikipedia.org/wiki/Butterfly_effect
• https://www.washingtonpost.com/weather/2020/02/02/butterfly-effect-is-not-what-you-think-it-is/
• https://fs.blog/2017/08/the-butterfly-effect/
• Wikipedia. org
• Aps.org
•Moonpointer. com
• https://www.britannica.com/science/principles-of-physical-science/Chaos#ref366471
লেখকঃ ফারজানা চুমকি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Responses