ঘটনা-০১

সামনে মালিহার পরীক্ষা, মালিহার পরিবারের সবাই, তার বন্ধু-বান্ধব এমনকি পাড়া-প্রতিবেশি তাকে এমন ভাবে হেয় তুচ্ছন্ন করেছে, তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে যে সে পরীক্ষায় ফেল করবে। এক পর্যায়ে মালিহার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জেগে উঠলো যে, সে পরীক্ষায় ফেল করবে এবং তাই সে আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলো না। 

ঘটনা-০২

বর্তমান যুগে একটা ছেলের বা মেয়ের গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড থাকা নিতান্তই বাস্তব ঘটনা। দীর্ঘদিনের প্রেমের পর সাকিবের তার গার্লফ্রেন্ড সুমির প্রতি আকর্ষণ চলে যাওয়ায় সে বাহানা খুঁজতে থাকে কিভাবে এ সম্পর্ক নষ্ট করা যায়। সভ্য সমাজে যাকে আমরা বলছি ব্রেক আপ। ব্রেকআপ করার জন্য সাকিব সুমিকে ইচ্ছাবশত সন্দেহের সুরে বলে যে, সে অন্য কোনো ছেলের সাথে ডেটিং এ গেয়েছে এমনটা সাকিব নিজ চোখে দেখেছে অথচ এমন কোনো ঘটনা আসলে ঘটে নি। সাকিব এমনভাবে বিষয়টি তুলে ধরে যে সে নিজেও নিজেকে সন্দেহ করা শুরু করে।

ঘটনা-০৩

সাদিয়া পরীক্ষার হলে নকল করার জন্য শিট নিয়ে যাওয়ার পর নিজে বাঁচার জন্য সেই শিট টেবিলের নিচে রাখা মিলির ফাইলে রেখে দিলো এবং ক্লাসে সকলের সামনে মিলি অপমানিত হলো। সবার ধারণা মিলি নকল করেছে বা মিলির নকল করার পরিকল্পনা ছিলো। এক সময় মিলি নিজেও সন্দেহ করা শুরু করেছে যে রাতে পড়ার পর শিটটি ভুলে ফাইলে রেখে দিয়েছে হয়তো।

ঘটনা-০৪

বেশিরভাগ পরিবারেই পিতা-মাতা ও বাচ্চার মধ্যে গ্যাসলাইটিং বিষয়টি দেখা যায়। বিয়ের ২বছর পর সন্তানের আগমন ঘটলো রায়হানের পরিবারে। সন্তানের নাম রাখলো শিহাব। শিহাবের জন্মের পরপরই রায়হানের ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ লস। এর কিছুদিন পরই রায়হানের বাবা ইন্তেকাল করলো। এসব কিছু দেখে সকলের ধারণা যে শিহাব অমঙ্গলের বাহক বলেই এ দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয় তারা। শিহাব যতই বড় হতে লাগলো বারবার হেরে যাওয়া তার মনে হতাশা আনে এবং বড় হতে হতে তার পরবারের কাছে শুনতে পাই সে অমঙ্গলের বাহক এবং এক পর্যায়ে সে বিশ্বাসও করে যে তার মধ্যে আসলেই মনে হয় অমঙ্গলের কিছু আছে। সে নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এই ভেবে বসে থাকে যে সে আনলাকি।

ঘটনা-০৫

ফাহিম তার বন্ধু জিহাদকে কিছু টাকা ধার দিলো। ৩ মাস পর সে টাকা খোঁজার পর জিহাদ বললো যে সে অনেক আগেই টাকা পরিশোধ করেছে, অথচ জিহাদ টাকা পরিশোধ করেনি। কিন্তু সে এমনভাবে বলছে যেন সে টাকা পরিশোধ করেছে কিন্তু ফাহিম সে টাকার কথা ভুলে গেছে এবং তার কাছে আবার টাকা চাইছে। এক সময়ে ফাহিমের মনে সন্দেহ জাগে যে হয়তো জিহাদ টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে কিন্তু সে ভুলে গেছে এবং তখন ফাহিমের মনে অনুশোচনা জাগে।সন্দেহের বীজ রোপণ হয় যে হয়তো সে কিছু ঘটনা ভুলে যাচ্ছে। 

উপরে যে ৫ টি উদাহরণ দিলাম হয়তো অনেকের জীবনে এমন ঘটনা ঘটেছে বা আপনি নিজেই অন্যের সাথে এমনটা করেছেন। আবার আমাদের আশেপাশের অনেকের জীবনে এমনটা ঘটতে দেখা যায়।

প্রথম উদাহরণ অনুসারে মালিহা হয়তো পরীক্ষায় পাশ করতো কিন্তু তার আপনজন, পাড়া-প্রতিবেশী মালিহাকে এটা বিশ্বাস করিয়েছে যে সে পরীক্ষায় ফেল করবে, দ্বিতীয় উদাহরণে ব্রেকআপ করার জন্য মিথ্যা অপবাদ বিশ্বাস করানো, তৃতীয় উদাহরণে মিলির রাতে পড়ে ভুল করে শিট ফাইলে রেখে দিয়েছে এমন সন্দেহ করা, চতুর্থ উদাহরণে শিহাব নিজেকে আনলাকি মনে করে হতাশায় ভুগা এবং পঞ্চম উদাহরণে ফাহিমের বন্ধু জিহাদ টাকা ফেরত দিয়েছে কিন্তু সে ভুলে গেছে এমনটা মনে করা এ বিষয়গুলোকে বলা হয় গ্যাসলাইটিং।

গ্যাসলাইটিং এক ধরনের মানসিক আপত্তি। গ্যাসলাইটিং হলো আপনার আশেপাশের মানুষজন আপনার সামনে কোনো বিষয়কে (যা আসলে আপনি করেননি বা আপনার জীবনে ঘটেনি) এমনভাবে উপস্থাপন করছেন যাতে আপনি তা বিশ্বাস করতে বাধ্য হন এবং এক পর্যায়ে আপনি তা নিয়ে অনুশোচনা করেন। এটি মানুষকে তার স্মৃতি, চিন্তাভাবনা ও চারপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে প্রশ্ন করে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।সহজ ভাষায় গ্যাসলাইটিং হলো একজন মানুষকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জালিয়াতি করা। 

Image credit: https://images.app.goo.gl/5ZfZaw4nMmCoDaZq5

গ্যাসলাইটিং শব্দটি ১৯৩৮ সালের নাটক এবং ১৯৪৪ সালের গ্যাসলাইট ফিল্ম থেকে উদ্ভুত। ফিল্মে স্ত্রী তার স্বামীর কাছে একটি চিঠি খুঁজে পাই যাতে কোনো এক সিক্রেট লেখা আছে। কিন্তু স্বামী তা অস্বীকার করে এবং এমন ভাবে তার স্ত্রীকে কনফিউজড করে যাতে সে মনে করে এটি তার ভুল ধারণা। আসলে এমন কোনো চিঠি সে পাইনি।

গ্যাসলাইটিং মানুষের মাঝে নিজের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে সন্দেহের সূচনা তৈরি করে। গ্যাসলাইটিংকে অনেকটা ব্রেন ওয়াশের সাথেও তুলনা করা যায়। আমরা সকলেই একে অন্যকে নানাভাবে গ্যাসলাইটিং করছি, সেটা হতে পারে সম্পর্কের শেষ করতে বা নিজের দোষ ধামাচাপা দিতে। আমাদের সকলের হয়তো রাখাল বালকের গল্প জানা আছে। এ গল্পে রাখাল বালক “বাঘ, বাঘ” করে গ্রামের মানুষকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করে যে বাঘ আছে। এ বিষয়টায় আসলে গ্যাসলাইটিং। গ্যাসলাইটিং একজন ব্যক্তির সনাক্তকরণে অসুবিধা তৈরি করে।

Image credit: https://images.app.goo.gl/iqLnsw4m6g7UhCh16

আমেরিকান সমাজতাত্ত্বিক পর্যালোচনার একটি নিবন্ধে উল্লেখ রয়েছে, যেকোনও ব্যক্তি গ্যাসলাইটিং কৌশল ব্যবহার করে কোনও ব্যক্তির লিঙ্গ, বর্ণ, নৃগোষ্ঠী, যৌনতা, জাতীয়তা বা বয়সের নেতিবাচক স্টেরিওটাইপগুলো তাদের ব্যবহারের জন্য ব্যবহার করতে পারে।

গ্যাসলাইটিং এর মূল উদ্দেশ্য ভুক্তভোগীকে বিভ্রান্ত করা যাতে অপরাধী তার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে পারে। ভুক্তভোগী যতটা সন্দেহপ্রবণ হয়ে যাবে অপরাধীর পক্ষে পরিস্থিতি ততটাই সহজ হয়।

রবিন স্টারন, পিএইচডির লেখা “The Gaslight Effect:How to Spot & Survive the Hidden Manipulation others use to control your life” বই এ গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হওয়ার লক্ষণগুলো উল্লেখ আছে:

১. গ্যাসলাইটিং এ আক্রান্ত ব্যক্তি যা করেন সবই ভুল অনুভব করেন।

২. যখন কোনো ভুল হয় তখন এটি তার নিজের দোষ চিন্তা করেন।

৩. প্রায়শই কিছু ভুল হয়েছে এমন ধারণা পোষণ করা, কিন্তু ভুলটি কি সনাক্ত করতে পারেন না।

৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ক্রমশ কঠিন মনে হচ্ছে।

৫. হতাশ বোধ করা এবং আপনি যে ক্রিয়াকলাপ উপভোগ করতেন তাতে কোনো আনন্দ পাচ্ছেন না।

যে মানুষগুলো গ্যাসলাইটার তারা সাধারণত নারকিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার নামে মানসিক ব্যাধি তে আক্রান্ত হতে পারে।

নারকিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। নিজের উদ্দেশ্য ছাড়া তাদের কাছে অন্যদের জন্য সময় বা আগ্রহ থাকে না।এ ধরনের ব্যক্তিরা মনোযোগ এবং প্রশংসা কামনা করে।

Image credit: https://images.app.goo.gl/UP1KvKbRjG7XzJRY8

একজন ব্যক্তি গ্যাসলাইটিং এর শিকার হয়েছে এটি বুঝতে পারা গ্যাসলাইটিং থেকে পরিত্রাণের প্রথম পদক্ষেপ। এর পরের পদক্ষেপ হতে পারে মনোবিজ্ঞানী বা থেরাপিস্টের সাথে পরামর্শ করা যারা ঐ ব্যক্তিকে সন্দেহ এবং ভয় কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবেন।

লেখকঃ জেরিন সুলতানা শাওন 

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,

নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ

Reference :

[1] https://www.aconsciousrethink.com/6766/gaslighting-examples/

[2] https://www.healthline.com/health/gaslighting#signs