বই : চা-কফি আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স
ক্যাটাগরি : ফিজিক্স
লেখক : Nayeem Hossain Faruque
রেটিং : ৯.৫/১০
আমাকে যদি আপনি ফিজিক্স এর কোনো বিষয় শেখাতে চান তাহলে আমি তখনি পার্ফেক্টলি আপনার কাছ থেকে ফিজিক্স শিখবো, যখন আপনি আমাকে-
- প্রথমে যে বিষয়টি বুঝাবেন তা প্রথমে Intuition (অন্তর্দৃষ্টি) এর মাধ্যমে ফিল করাবেন।
- তারপর সেই Intuition (অন্তর্দৃষ্টি)এর আঙ্গিকে বিষয়টিকে সংজ্ঞায়ন করেন।
- এবং সব শেষে বিষয়টিকে ম্যাথম্যাটিকালি এক্সপ্রেস করেন।
যখন শুধু Intuition (অন্তর্দৃষ্টি) দিয়ে বুঝাবেন, তখন তাকে বলা হয় পপ-সায়েন্স যা আমাকে বিষয়টিকে ফিল করতে সাহায্য করে। শেষে যখন বিষয়টি ম্যাথম্যাটিক্যালি প্রকাশ করবেন, তখন তা আমি পূর্ণাঙ্গ ভাবে বুঝতে পারবো। কারণ ম্যাথম্যাটিকস হচ্ছে বিজ্ঞানের ভাষা। আর শুধু কিছু ম্যাথ পারাটা ফিজিক্স বুঝা নয়। ম্যাথ অনেকেই পারে, কিন্তু বিষয়টি কেনো হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, এভাবে কেনো! অন্যভাবে নয় কেনো! তা যদি না বুঝেন তাহলে আপনি ফিজিক্স এর ফ-ও বুঝবেন না। তাই ফিজিক্স বুঝতে এই দুই এর সুপার কম্বিনেশন প্রয়োজন।
◾আমাদের একাডেমিক বই পুস্তক এর ধারে কাছেও নেই। যার কারণে আমরা বেশির ভাগই ম্যাথ পেরে পাশ করি, কিন্তু বিষয়টা যখন ব্যাখ্যা করতে বলা হয়, তা পারি না।
আবার কিছু অতিরঞ্জিত পপ টাইপ বই আছে, যা আপনাকে ক্যালকুলাসের ক পারেন না অথচ ব্ল্যাক হোল নিয়ে গবেষণা শুরু করে বিজ্ঞানী হয়ে গিয়েছেন এমন ভাব তৈরী করাবে।
এই উভয়ের সুপার কম্বিনেশন যে প্রয়োজন তা আমি এই ‘চা-কফি ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স’ বইটি না পড়লে বুঝতাম না।
“এই বইটা যেহেতু পপ সায়েন্সের বই, আমরা প্রায়ই এটা ওটা গল্প করবো, আড্ডা দিবো। আবার একই সাথে এটা পপ সায়েন্সের বই না। এখানে মাঝে মাঝেই অংক শেখানো হবে।”
বই থেকে একটা উদাহরণ টানা যাক।
◾বক্কর ভাই তখন একেবারেই ছোট। ক্রিমিনাল মাস্টারমাইন্ড হতে অনেক দেরি আছে। ছোট বক্কর ভাই পুকুরে ঢিল ছুঁড়ছেন। ঢিল মেরে কি ব্যাঙ শিকারের চেষ্টা করছেন? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে পুকুরের মাঝ বরাবর ঢিল মারলে পানিতে ঢেউ হচ্ছে। সেই ঢেউ দুইটা কাজ করছে-
- এক জায়গায় উঠছে নামছে
- চারপাশে ছড়াচ্ছে
ঢেউ কিভাবে উঠে নামে? জিনিসটা বাঙ্গালিদের মতো। ঢিলের পাশের জায়গাটাই ধরো। সেখানে উপরে উপরে অনেকগুলো পানির কণা ছিলো। ঢিলের ধাক্কায় সবচেয়ে উপরের পানির কণাটা উপরে উঠা শুরু করলো। সে তারপর টেনে তুললো তাঁর পেছনের কণাকে, তারপর তার পেছনের কণাকে। যত বেশি শক্তি থাকবে ঢিলের, তত উঁচু হবে পানির কণার ঢেউ।
কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ বলো? একটা কণা উপরে উঠলে তাঁর নিচের কণাদের হিংসে হয়। তারা তাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করে।
মনে করি, তরঙ্গের মধ্যে প্রতিটি কণা একঘর উঁচু। তার মধ্যে একটা কণার নাম হচ্ছে জসিম। এই জসিম নামের কণাটিকে আমরা একটু কাছ থেকে দেখে আসি।
জসিম প্রথমে ছিলো সাম্যবস্থায়। মধ্যবিত্তের জীবন। সে একঘর উপরে উঠলো। তার পেছনে একটা কণা লাগলো। জেলাস ফ্রেন্ড জসিম দুই ঘর উপরে উঠলো। তার পেছনে লাগলো দুইটা কণা। পাড়ার মাস্তান পিছে লাগলো।
জসিম ৩ঘর উপরে উঠলো। বাড়ি-গাড়ি করলো। এবার পিছে লাগলো এলাকার পাতি নেতা।
এক সময় জসীম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দিলো। অনেকের কাজ জুটলো সেখানে। পিছে লাগলো রাজ্য জোড়া লোক। জসিমকে টেনে নামালো উপর থেকে।
জসিম গার্মেন্টস হারালো, বাড়ি হারালো, গাড়ি হারালো, শেষ পর্যন্ত পথে নামলো। শেষে সে শুরু করলো রিকশা চালানো।
তারপর জসিম আবার উঠা শুরু করলো। রিকশা থেকে সিএনজি ধরলো, তারপর উবার চালানো শুরু করলো, তারপর টার্কির খামার, দেখতে দেখতে সে আবার আগের মতো গার্মেন্টসের ব্যবসা শুরু করলো। কিংবা এবার বিসিএস দিয়ে লাল হয়ে গেলো। তারপর আবার পতন শুরু হলো।
ফর্মাল কথায় আসি। অনেক গল্প হয়েছে, ঢেউ এর কথা হচ্ছিলো, জসিমের না।
প্রথমে ভাবি ছোট খাটো একটা ঢেউ। সময় যখন শূণ্য তখন ঢেউ-এর উচ্চতা হচ্ছে ০।একটু পর হয়তো .5, তারপর 0.7 এক সময় হয়তো 1। আবার সে নামতে নামতে শুণ্য হবে। একসময় উল্টোদিকে নেমে 1 হবে, আবার ব্যাক করবে শুণ্যতে।
আমরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের ঢেউয়ের উচ্চতা মাপলাম।
t=0 হলে, উচ্চতা 0
t=30 হলে,উচ্চতা 1/2
t=45 হলে, উচ্চতা 1/√2
t=60 হলে, উচ্চতা √3/2
t=90 হলে, উচ্চতা 1।
মানগুলো চেনা চেনা লাগছে? এগুলো হচ্ছে সাইন (থিটা)-এর মান।
আমরা লিখতে পারি,তরঙ্গের উচ্চতা y হলে,
y=sint।
ঠিক যেন কেউ কোন কিছুকে গোল করে ঘুরাচ্ছে, আর সেটার সাইনের মান নিচ্ছে।
এভাবে লেখক একটু একটু করে জসিম, বক্কর ভাই,আক্কাস আলীর গল্পে গল্পে তরঙ্গের সাধারণ সমীকরণ y=Asin(wt-kx+Ø) থেকে শুরু করে বর্তমান কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর সবচেয়ে সুন্দর সমীকরণ “শ্রোডিঙ্গারের ইকুয়েশন” প্রমাণ পর্যন্ত পাঠককে ঘুরিয়ে এনেছেন। মনের মধ্যে তৈরি করেছে কিউরিওসিটি, কি এই ইলেক্ট্রন? এটা কি সলিড কোন কিছু? নাকি তরঙ্গ? কিভাবে ইলেক্ট্রন কণা হয়ে ব্যতিচার-এর মাধ্যমে পর্দায় তুলে ঢেউ এর ছবি? লেখক ভার্নার হাইজেনবার্গ-এর মাধ্যমে তুলেছেন রক্তে শিহরণ। এটা ফিল করিয়েছে যে, যে রিয়েলিটিকে আমরা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি সেটা রিয়েলিটি না।
◾ বই যে কি পরিমাণ বন্ধুসুলভ শিক্ষক হতে পারে তা আমি ‘চা-কফি ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স ‘ না পড়লে বুঝতে পারতাম না।
এখানে লেখক প্রতিটা বিষয় এমন ভাবে বুঝিয়েছেন, যেনো শিক্ষক একটা একটা চলচ্চিত্র পাঠক-কে দেখিয়ে চলেছেন। ফিল করাচ্ছেন প্রতিটা বিষয়। তিনি শুধুই বুঝিয়ে যান নি পাঠক-কে ভাবতে দিয়েছেন।
কেনো তরঙ্গ সাইন-এর সূত্র ফলো করে? ত্রিভুজ-চতুর্ভূজ কেনো নয়? শুধু তাই-ই নয়, তিনি পাঠকের জন্য দিয়েছেন হোম-ওয়ার্ক!
◾ ম্যাথ কষতে কষতে বোরিং হয়ে গিয়েছেন? লেখক আপনার জন্য দিয়েছেন চা পানের বিরতি। চা পান করতে করতে ঘুরিয়ে আনবেন লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার,মাল্টিভার্সে আইনস্টাইন এর মতো রহস্যময় জগত থেকে!
◾ লেখকের অফুরন্ত চেষ্টার জন্য লেখককে স্বাগতম। তবে এক্ষেত্রেও কিছু ফাঁক ফোকর থেকে গেছে হয়তো। মাঝে মধ্যে Intuition (অন্তর্দৃষ্টি)থেকে এর আঙ্গিকে সংজ্ঞায়ন করা হয়ে উঠেনি। যার কারণে কয়েকটা টপিক ক্লিয়ার ছিলো না। কনফিউশনের সৃষ্টি করেছে। যেমন ৪৭ পৃষ্ঠায় তরঙ্গ বুঝাতে গিয়ে বলেছেন,
“পরপর দুইটা একই দিক থেকে আসা শূণ্যের মাঝখানে কণা আছে কয়টা? ১৬টা। এর তরঙ্গের দৈর্ঘ ১৬।”
এখানে আসলেই কি ১৬টা কণা থাকে? তরঙ্গ দৈর্ঘ কি এর কণার সংখ্যার উপর নির্ভর করে? যা তরঙ্গ দৈর্ঘের আসল সংজ্ঞার সাথে যায় নি মনে হলো। তবে পরে তা অন্যভাবে ক্লিয়ার কিরা হয়েছে।
এরকম ছোট খাটো কয়েকটা বিষয় আমার নিজের ই বুঝতে অসুবিধে হয়েছে।
◾সামগ্রিক বিবেচনায় বইটি এক কথায় অনবদ্য। যা রকমারি ডট কম সাইটে পদার্থ বিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে বর্তমানে ৪র্থ। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিষয়টির জন্য একেবারে প্রিলিমিনারি বই বলা যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং এ যাদের কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর পার্ট আছে তাদের যেভাবে পড়ানো হয় তা দিয়ে এর আসল অর্থ বুঝা সম্ভব না। তবে শুরুতে এই বইটি পড়ে নিলে আমার মনে হয় অনেক কিছু ফিল করতে সাহায্য করবে।
তাহলে চা কফি খেতে খেতে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর রহস্যময় দুনিয়াতে ঘুরে আসতে সবাইকে আমন্ত্রণ।
[বিঃদ্রঃ সামনে আসছে লেখকের ‘চা-কফি ও জেনারেল রিলেটিভিট। লেখকের জন্য রইলো শুভকামনা]
ধন্যবাদ।
লেখকঃ মোহাম্মদ ফাহিম উদ্দীন
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগ
Responses